a
ফাইল ছবি: শাহ্ আবদুল হান্নান
বিশ শতকের শেষার্ধ থেকে দুনিয়াজুড়ে মুসলিম পুনর্জাগরণবাদ একটি বড় ঘটনা হয়ে ওঠে। এটি দ্রুত মিডিয়ার শিরোনাম হয় এবং এটিকে ভিত্তি করে প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন চলে। মুসলিম জগতের দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতা তার মুসলিম আত্মপরিচয়কে সংশয়াপন্ন করে তুলেছিল। এই পুনর্জাগরণবাদ বিস্মৃত পরিচয়কে খুঁজে বের করে এবং ব্যক্তি ও জনপরিসরে ইসলামী পরিচয়কে বুনিয়াদ করে নতুন এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মাত্রা সৃষ্টি করে। এই নতুন মাত্রা আধুনিক ইসলামের গতিশীলতা ও নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের শাহ্ আবদুল হান্নান এরকম একজন চিন্তক পুরুষ, যার মধ্যে আমরা এই নতুন ভাবনার স্ফুরণ দেখি।
ব্যক্তিজীবনে একজন উচ্চপদাধিকারী আমলা হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের ওপর তার গভীর পড়াশোনা, ইজতেহাদি মন, আধুনিক জগতের প্রেক্ষিতে ইসলামকে বোঝাপড়ার কৌশল এবং নানামুখী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে তার প্রাণবন্ত ও সজীব অংশগ্রহণ তাকে বাংলাদেশের ইসলামী ভাবজগতের নেতৃস্থানীয় পুরুষে পরিণত করেছে।
ইসলামী পুনর্জাগরণবাদের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতির বিকাশ। ইসলামী অর্থনীতি বলতে এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক- দু’টি দিকই বোঝায়। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশে ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছে। এ সময় মুসলিম অর্থনীতিবিদরা ইসলামী শিক্ষার আলোকে ইসলামী অর্থনীতির একটি কাঠামোগত রূপ দেন। এটি জ্ঞানজগতে ইসলামী অর্থনীতি হিসেবে চালু হয়ে যায়। ইসলামী অর্থনীতি বিকাশের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্বেরও উত্থান ঘটেছে, যারা একই সাথে তাত্ত্বিক ও সক্রিয় কর্মী। এ ক্ষেত্রে খুরশিদ আহমদ, উমর ছাপরা প্রমুখ খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিকাশে শাহ্ আবদুল হান্নান অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। অ্যাকাডেমিয়া ও সরকারি বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অবস্থান করে তিনি ইসলামী কাঠামোর মধ্যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও চর্চার একটি অনুসরণীয় মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। তাকে বাংলাদেশের ইসলামী অর্থনীতির জনকও বলা যায়।
ইসলাম অর্থনীতিকে মূল্যবোধকেন্দ্রিক হওয়ার ওপর জোর দেয়। ধনতন্ত্রের অবাধ স্বাধীনতা এবং সমাজতন্ত্রের সামাজিক মালিকানার ধারণা দুনিয়ায় অনেক ভালো কাজ করলেও বাস্তবে অর্থনৈতিক অসমতা দূর করতে পারেনি। বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ধনতন্ত্রের হাতে। কিন্তু ধনতন্ত্র দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠা করেছে একধরনের সোস্যাল ডারউইনিজম। ধনতন্ত্রের মাধ্যমে এখানে ধারণা দেয়া হয়েছে অর্থনীতিতেও ন্যাচারাল সিলেকশন হবে। শুধু যোগ্যরাই বেঁচে থাকবে, গরিবদের স্থান থাকলেও সেটি খুব প্রান্তিক অবস্থান হবে। এখানে এথিকসের কোনো জায়গা নেই। শাহ্ আবদুল হান্নান তাই সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আর তা-ই যদি হয় তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা দরিদ্রের জন্য কাজ করব? দারিদ্র্য কেন দূর করব? কেন আমরা নিরক্ষরতা দূর করব? কেন আমরা বঞ্চিত জনগণের জন্য কাজ করব? এসবই তো মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত।’
আসলে ধনতন্ত্র হলো একটি মূল্যবোধহীন অর্থনীতি। ঠিক এই প্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থনীতির ধারণাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ এটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন। এর তিনটি ভিত্তি : তাওহিদ, খেলাফত ও ইনসাফ। তাওহিদ মানে হচ্ছে সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি এবং এটি কোনো তাৎপর্যহীন ঘটনা নয়। সবমানুষের গুরুত্ব রয়েছে এবং প্রত্যেককে গুরুত্ব দিতে হবে। খেলাফত মানে হচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ আল্লাহর খলিফা। সে কোনো দৈবাৎ ঘটনা নয় বা জন্মগত অপরাধী নয়। এই নীতির ভিত্তিতে সব মানুষ সমান। সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। এই সমতার বৈশিষ্ট্য বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। এটি খেলাফতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। মানুষ সম্পদের আমানতদার। সে মূল মালিক নয়। সে নিজের ইচ্ছামতো সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে না। সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী। এটি খেলাফতের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য।
ইনসাফের দাবি হচ্ছে সব মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করতে হবে। সবার জন্য সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনভাবে অর্থনীতিকে সাজাতে হবে, যাতে সবার আয়ের ব্যবস্থা হয়।
ইসলামী অর্থনীতির কতকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোই এটিকে ধনতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে পৃথক চরিত্র দিয়েছে। শাহ্ আবদুল হান্নানের ভাষায়, ‘ইসলামী অর্থনীতির ইসলামিত্ব হচ্ছে তার মূল্যবোধ এবং তার প্রয়োগনীতিতে। অর্থনীতি বিষয়ে কয়েকটি প্রধান ইসলামী মূলনীতি হচ্ছে- সুদ নিষিদ্ধকরণ, সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি, দুস্থদের জন্য সামাজিক ব্যবস্থা (জাকাত), ব্যবসায় ও জীবিকা অনুসন্ধানের অধিকার, অর্থ ও সম্পদ জমাকরণের বিরুদ্ধে শক্ত মনোভাব, ইসলামের মিরাসি ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির প্রতিরোধ।’
শাহ্ আবদুল হান্নান মনে করতেন, ইসলামের জাকাত-ব্যবস্থা দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে জাকাত চালু আছে সেটি দিয়ে তা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কেন্দ্রীভূতভাবে জাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থা হলে সবচেয়ে ভালো হয়। অথবা কোনো সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। জাকাত এমনভাবে দিতে হবে, যাতে জাকাত গ্রহীতা একেবারে স্বাবলম্বী হয়ে যায়। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার বাস্তব প্রয়োগ ব্যতীত দারিদ্র্য দূর করা কঠিন কাজ।
ইসলামী কাঠামোর মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণের আরেকটি টুলস হলো ওয়াক্ফ ব্যবস্থা। মুসলিম জগতে দীর্ঘ কলোনিয়াল শাসন ওয়াক্ফ ব্যবস্থাকে রীতিমতো তছনছ করে দিয়েছে। আল্লাহর পথে দান-খয়রাত ইসলামী নৈতিকতার অংশ। এ কারণে মুসলমানরা কিছু সম্পদ দরিদ্রদের জন্য সবসময় ওয়াক্ফ করতেন। ওয়াক্ফের আয় থেকে মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা চলত, এমনকি দরিদ্র ছাত্রদের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। শাহ্ আবদুল হান্নান ওয়াক্ফ ব্যবস্থাকে পুনর্জীবিত করার পক্ষপাতী ছিলেন, যাতে মুসলিম সমাজে দারিদ্র্যের অবসান হয়।
ব্যাংকিং আধুনিক অর্থনীতির প্রাণ। কারণ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই অর্থের আদান-প্রদান হয় এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতি গড়ে ওঠে। বিশ্বব্যাংকের চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রামের (এফএসআরপি) প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের দায়িত্ব পালনকালে তার তত্ত্বাবধানে নিম্নোক্ত সংস্কারগুলো গৃহীত হয়- ঋণ শ্রেণিকরণের আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণ; আন্তর্জাতিক নিয়মের রিস্ক ওয়েটেড ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি পদ্ধতি গ্রহণ; ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো চালুকরণ; লেন্ডিং রিস্ক অ্যানালাইসিস বা ক্রেডিট রিস্ক অ্যানালাইসিস চালুকরণ ইত্যাদি। এসব নীতিমালার সংযোজন ব্যাংক তথা আর্থিক খাতকে বিশ্বমানে উত্তরণে ভূমিকা রাখে। ১৯৯১ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) প্রবর্তন হয়।
শাহ্ আবদুল হান্নান ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ইসলামী ব্যাংকিং যদি জাতীয় ব্যাংকিং পদ্ধতি হয় তাহলে সুদ উঠে যাবে। ইসলামের সামাজিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্যাবলি প্রতিষ্ঠা করা তখন সহজ হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের একটি লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের চাহিদা পূরণ করা। চাহিদা পূরণ না করতে পারলে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আর ইনসাফ না থাকলে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে না, সঙ্ঘাতমুক্তিও ঘটবে না। বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে শাহ্ আবদুল হান্নানের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে এটিকে তিনি তাত্ত্বিক জায়গা থেকে প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতার পশ্চাতে তার কারিশমা একটি বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে। তিনি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান আইন সংস্কার করেন। ফলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হয়।
শাহ্ আবদুল হান্নানের একটি অগ্রাধিকারের বিষয় ছিল সমাজে নারীর অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ছিলেন নারীর মুক্তি, অধিকার ও স্বাধীনতার একজন প্রবল কণ্ঠস্বর। ইসলামী কাঠামোর মধ্যে থেকে তিনি নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, ইসলামী কাঠামোর মধ্যে নারীকে যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি। কিন্তু বাস্তবে সেই অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত হয়। বাস্তব ও তত্ত্বের এই ফারাক তাকে ব্যথিত করেছে। তিনি উপলব্ধি করেছেন, আমাদের জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার ফলে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মুসলিম জীবনে ইসলামী মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন যাতে কি না নারীর ওপর জুলুমের অবসান ঘটে।
সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে নানা কথা শোনা যায় বটে, কিন্তু আমাদের সমাজে নারীরা যে অনেকসময় অত্যাচারের শিকার হয়- এটিও মিথ্যা নয়। পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, মোহরানা না পাওয়া এগুলো যে অহরহই ঘটে তাও অস্বীকার করা যাবে না। এর ফলে অনেকের মধ্যে একটি ধারণা হয়- এ অবস্থার জন্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ইসলামই দায়ী। ইসলামের কারণেই নারীদের ছোট করে দেখা হয় এবং তারা অধিকারবঞ্চিত হয়। ফলাফল যা হয় তা আরো মারাত্মক। অনেকেই ইসলাম থেকে বিদ্রোহ করে পশ্চিমা নারীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
শাহ্ আবদুল হান্নানের কথা হলো, ইসলামী কাঠামোর মধ্যে নারীর যে অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা কথায় নয়, কাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলামের মধ্যে তার নিজের মতো করে নারীর ক্ষমতায়নের একটি ব্যবস্থা আছে। ইসলামী ফ্রেমওয়ার্কে নারীর যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা ইসলামের আবির্ভাবকালীন সময়ের চেয়ে চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে অনেক অগ্রসর ছিল। শাহ্ আবদুল হান্নান দেখান, এটি আজকালকার পরিপ্রেক্ষিতেও অনেক অগ্রসর চিন্তা। এমনকি পশ্চিমের চেয়েও। তাহলে মুসলিম সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কেন?
শাহ্ আবদুল হান্নান লিখেছেন, ‘ধর্ম মানুষের মধ্যে নিঃস্বার্থপরতা ও অন্যকে অগ্রাধিকার প্রদানের যে মানসিকতা সৃষ্টি করে তা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ দেশের নারীরা যে অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে তা ধর্মের কারণে নয়; বরং ধর্ম থেকে আমাদের বিচ্যুতির কারণে। আমাদের মধ্যে সৃষ্ট স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা ও ভোগস্পৃহাই এর জন্য দায়ী।’ তাহলে এর প্রতিকার কী? শাহ্ আবদুল হান্নানের ভাষায়- ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, তাদেরকে সে অধিকার ভোগ করার সুযোগ তথা সামাজিক অবস্থা তৈরি করে দেয়া।’
শুধু লেখালেখির মাধ্যমে নয়, নানারকম সামাজিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে নারী প্রশ্নটিকে তিনি সবসময় সজাগ করে তুলেছেন। নারীর হিজাবের অধিকারের প্রশ্নে তিনি সোচ্চার ছিলেন। ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, নারী অপহরণ, যৌতুক, পর্নোগ্রাফি প্রভৃতির বিরুদ্ধে তার আপসহীন ভূমিকা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুধু তাই নয়, এসব প্রশ্নে তিনি সমাজের ইন্দ্রিয়কেই জাগানোর চেষ্টা করেননি, তিনি এর বিপক্ষে রীতিমতো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলারও চেষ্টা করেছেন। তিনি জানতেন, সমাজ না জাগলে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
চিন্তাগতভাবে শাহ্ আবদুল হান্নান ছিলেন মধ্যপন্থী। ইসলামের নামে তিনি কোনো রকমের বাড়াবাড়িকে সমর্থন করেননি। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি ইসলামকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে আধুনিক সভ্যতার প্রচুর অগ্রগতি ও অর্জনের সামনে তিনি ইসলামকে নতুন করে পাঠ করেছেন। একালে ইসলামের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো কী রকম হবে তা নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছেন। কুরআন ও হাদিসের মৌলিক নীতির ভিত্তিতে তিনি একালের মুখোমুখি হয়েছেন এবং ইসলামের পুনর্ব্যাখ্যা করেছেন।
শাহ্ আবদুল হান্নান মনে করতেন, চরমপন্থা ইসলামকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কিন্তু ইসলামের স্বভাব মধ্যপন্থা, চরমপন্থা নয়। চরমপন্থা ক্ষুদ্র বিষয়কে বৃহৎ করে তোলে। চরমপন্থীরা কারো কথা শুনতে চায় না। সমন্বয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বয় তারাই করে, যারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। চরমপন্থা উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় না। আর মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ না হলে সে কী করে জাগবে?
শাহ্ আবদুল হান্নান মুসলিম জগতে একধরনের ভাববিপ্লবের পক্ষপাতী ছিলেন। বহুদিন ধরে মুসলিম জগতে বুদ্ধিবৃত্তির খরা চলছে। এই খরা নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার সৃষ্টিশীলতার টগবগে আগুনকে মোকাবেলা করা যাবে না। শাহ্ আবদুল হান্নান চেয়েছিলেন মুসলিম জগতে চিন্তার চাষাবাদ হোক, গবেষণার ফুল ফুটুক, সৃষ্টিশীলতার আগুন টগবগিয়ে উঠুক। মুসলিম জগতে একটি বর্ধনশীল জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠুক। তিনি তার কৃতি ও সাধনার ভেতর দিয়ে বারবার আমাদের এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। সূত্র: নয়াদিগন্ত
লেখক : ফাহমিদ-উর-রহমান
ছবি: মুক্তসংবাদ প্রতিদিন
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গাইবান্ধায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত। সম্প্রতি গাইবান্ধা শহীদ মিনার প্রাঙনে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অন্তরঙ থিয়েটারের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা ও তিনমাত্রা নামে এক ভিন্নধর্মী নাটক অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ পরিষদ ও সার্ক কালচারাল সোসাইটির সভাপতি এটিএম,মমতাজুল করিম,গানাস সভাপতি এডঃকেএম হানিফ বেলাল।
বক্তব্য রাখেন গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সভাপতি অমিতাভ দাস হিমুন,কবি সুলতান উদ্দিন আহমেদ, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলমগীর কবির বাদল।সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফারুক শিয়ার চিনু। সভায় বিশেষ অতিথি মমতাজুল করিম বলেন, দেশের মানুষ আজ তাদের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছে। আমাদের অপসংস্কৃতি রোধে সুষ্ঠু ধারার সংস্কৃতি চালু করতে হবে।অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
ছবি সংগৃহীত
কর্নেল(অব.) আকরাম: ষড়যন্ত্র আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের জাতি অতীতে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে এবং এর ফলে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ষড়যন্ত্র আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
ভারতে মুসলিম শাসনের সময় ষড়যন্ত্র ছিল একটি সাধারণ ঘটনা। প্রাসাদ অভ্যন্তরের কূটচাল এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বহু শাসকের পরিবর্তন ঘটেছে। পুরো মুসলিম শাসনামলেই রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র শাসকের পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে এই সময়ে বাইরের কোনো শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপের নজির ইতিহাসে ছিল না।
বিদেশি শক্তির প্রথম প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্র দেখা যায় বাংলায়, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে। কোম্পানি নবাবের সেনাপ্রধান মীরজাফর এবং মুর্শিদাবাদের হিন্দু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলার শাসনভার দখল করে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুর্শিদাবাদের হিন্দু ব্যাংকারদের সহযোগিতার ফলে বাংলার স্বাধীনতা হারায়, আর ভারতবর্ষের মুসলমানরা প্রায় দুইশত বছরের জন্য ব্রিটিশদের দাসে পরিণত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের পরিণতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিল যে, পুরো ভারতবর্ষের মুসলমানরা সমাজের নিপীড়িত শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনামলে একের পর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হতে থাকে। কলকাতার হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে এবং ১৯১১ সালে ব্রিটিশদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এটি বাতিল করতে বাধ্য করে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে একই হিন্দু অভিজাত শ্রেণি বাংলাকে একত্রিত রাখতে দেয়নি। এটি ছিল কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের গভীর ষড়যন্ত্র।
ভারতের মুসলমানরা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম পর্যন্ত একের পর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণি নতুন সুযোগের সন্ধান পায় এবং উন্নতির স্বপ্ন দেখে। কিন্তু স্বাধীনতার শুরু থেকেই ভারত ষড়যন্ত্রমূলক নীতি গ্রহণ করে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করে। ভারত দ্রুত সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিস্ট দল এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।
ভারতের ষড়যন্ত্র তখনই প্রকট হয়ে ওঠে যখন শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল ভারতের ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট প্রমাণ। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। এই সুযোগে শেখ মুজিব তার ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ছয় দফা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ভারত-সমর্থিত আওয়ামী লীগের চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয় হতে শুরু করে। আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে কয়েকজন তরুণ নেতা স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু গঠন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি ষড়যন্ত্র শুরু করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালায়।
এই সুযোগে ভারত দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়। মাত্র নয় মাসের মধ্যে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। ভারতের ষড়যন্ত্র সফল হয় এবং তারা বাংলাদেশকে একটি আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের ষড়যন্ত্র পুরনো সামাজিক কাঠামো, ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করার দিকে মোড় নেয়। কথিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর মাধ্যমে সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধকে দুর্বল করা হয়। গত পাঁচ দশকে আমরা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, শিক্ষার মানের বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে আমাদের অযোগ্যতার প্রমাণ পেয়েছি। ভারতের ষড়যন্ত্র এতটাই সফল হয়েছে যে, আমরা কখনো তা বুঝতে পারিনি।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, জিয়াউর রহমান ছাড়া, ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জিয়াউর রহমান নিহত হন। গত ৫৪ বছরে আমরা ভারতের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হতে পারিনি, বরং প্রতিবার তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি।
বেগম খালেদা জিয়া দুইবার জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও, দুবারই তার নিজের নিয়োগকৃত সেনাপ্রধানদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের হাত ছিল, কিন্তু তার গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এটি আগে থেকে বুঝতে পারেনি। ফলাফল—আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি করলেও এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং সবকিছু আরও জটিল হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, আর জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতি আজও সক্রিয় রয়েছে, অন্যথায় কেন রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পরিবর্তে ভারতের সমর্থনের প্রত্যাশা করবে? আমরা কি কখনো ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে পারব? এটি আজ জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
লেখক: ড. শেখ আকরাম আলী
লেখক ও আন্তর্জাতিক কলাম লেখক, মুক্তসংবাদ প্রতিদিন