a
লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই দিনের বাংলাদেশ সফর সফল না ব্যর্থ? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র দিল্লির সাউথ ব্লক এবং ঢাকার সেগুনবাগিচা। কিন্তু ভারতে মোদিবিরোধী প্রতিক্রিয়া এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অবিজেপি-শাসিত সব রাজ্যের নেতারা ধিক্কার জানিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং লিখিত বিবৃতি দিয়ে মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, মোদির বক্তব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যার সহযোদ্ধা ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী- এ কথা বিশ্ব জানে, জানে বাংলাদেশ, জানে ভারতবর্ষ। সেখানে বিজেপির আরেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির কোনো ভূমিকাই ছিল না। তিনি কোনো সংগঠনও তৈরি করেননি, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান-আমেরিকা বিরোধী কোনো আন্দোলনও করেননি।
মোদি তাঁর বক্তব্যে শুধু ইন্দিরাজিকেই অপমান করেননি, অটলজিকেও অপমান করেছেন। মোদি ঢাকায় বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি সত্যাগ্রহ করেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন অসত্য বিবৃতি দেওয়া দেশের পক্ষে অপমানজনক বলে মনমোহন সিং মনে করেন। মোদির তখন বয়স ছিল আঠারো কি উনিশ। তখন তিনি আরএসএস স্কুলের ছাত্র। ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার কোনো অধিকার তার থাকা উচিত নয়। ঢাকায় তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যে এ ধরনের বজ্জাতি করবেন তা ঢাকা সফরের চার দিন আগেই জানা গিয়েছিল। কারণ ঢাকা সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিজেপি অফিস প্রচার করে মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন।
মনমোহন সিং তাঁর বিবৃতিতে আরও বলেছেন, এ অসত্য বিবৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। ঢাকায় তাঁর উক্তির পরে ভারতের আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার), যে আইনটি মনমোহনের আমলেই হয়েছিল, সে আইনটিও তুলে দেওয়ার জন্য মোদি এবং অমিত শাহ আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন।
Bangladesh Pratidinমনমোহন সিং মোদির ঢাকা সফরের বিকৃতি নিয়ে এতই ক্ষুব্ধ যে তিনি মোদির উদ্দেশে বলেছেন, দোহাই আপনার, দেশের বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই নবীন প্রজন্মের কাছেও ইতিহাস বিকৃত করবেন না। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, আপনাকেও করবে না। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ইন্দিরাজি লোকসভায় যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করছিলেন তখন অটলজি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন (সংসদের রেকর্ড দেখতে পারেন), আপনি দেবী দুর্গা। আপনি এক অসাধারণ কাজ করেছেন।
মোদি আপনার বিবৃতিতে তো সে কথাটি বলেননি। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর আপনি বলেছিলেন আর এখনো বলছেন, আপনি গান্ধী পরিবারকে ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে দেবেন। মনমোহন সিং বলেছেন যারা ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেন তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। ইতিহাস ইতিহাসই। আপনার জানা উচিত গুজরাট দাঙ্গায় শত শত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হওয়ার সময়ে সংসদে দাঁড়িয়ে বিজেপির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলজি বলেছিলেন, আপনি রাজধর্ম পালন করেননি। তিনি আপনাকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি লালকৃষ্ণ আদবানির বদান্যতায় সেদিন গুজরাটের ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিলেন।
বাজপেয়িজি আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র, তাই তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে অসত্য কথা বলা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। আপনি বাংলাদেশে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ভোটে জেতার জন্য মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। পুজো দেওয়ার অধিকার আপনার আছে, কিন্তু সে পুজো পুঁজি করে ভোটব্যাংক তৈরি বা ক্ষমতা দখলের চেষ্টার কোনো অধিকার আপনার নেই।
মোদির বাংলাদেশ সফরের এক দিন পর নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা সাংবাদিকদের ডেকে কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা, ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার ইতিহাস আপনার অজানা থাকার কথা নয়। অথচ আপনি এ ব্যাপারে একটি শব্দও ঢাকায় উচ্চারণ করেননি।
সুরজেওয়ালা আরও বলেছেন, বাজপেয়িজির প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে সংসদে সন্ত্রাসবাদীদের হামলার সময় অটল বিহারি বাজপেয়ি প্রথম ফোনটি পান তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কাছ থেকে। সোনিয়া গান্ধী ফোন তুলেই অটলজিকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোথায় আছেন? কেমন আছেন? সে বছরই সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ি সাংবাদিকদের এ গোপন কথাটি উল্লেখ করে বলেছিলেন, নীতিগতভাবে আমাদের মধ্যে যত বিভেদই থাক, আমরা ভারতবাসী হিসেবে এক এবং ঐক্যবদ্ধ। দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই সংসদ হামলার সময় বিরোধী দলের নেত্রী হয়েও সোনিয়াজি আমার কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন। এই হলো সৌজন্য।
রাজীব গান্ধী হত্যার পর তাঁর শোকসভায় দাঁড়িয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ি বলেছিলেন, রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিতে যাবেন, তখন তিনি খবর পেলেন অটলজি খুব অসুস্থ, তাঁর বিদেশে চিকিৎসা দরকার। রাজীব অটলজিকে বললেন, আপনাকে আমার সঙ্গে নিউইয়র্কে যেতে হবে। আপনার চিকিৎসা দরকার। রাজীব গান্ধী কোনো দিন কাউকে এ কথা বলেননি। তিনি অটলজিকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কে যান এবং তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু এ কথাটি ফাঁস করে দেন অটলজি, রাজীব গান্ধীর হত্যার পর তাঁর স্মরণসভায়। এটাই ছিল ভারতের গণতন্ত্র ও সৌজন্য।
মোদির ঢাকা সফরের পর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন বিদেশ সচিবের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা দেখেছেন নেহরু থেকে নরসীমা রাও বা মনমোহন সিং সবাই এক অসামান্য সৌজন্যবোধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি পেশাগত কারণে নয় মাসের প্রতিদিনের বড় বড় ঘটনার সাক্ষী ছিলাম এবং আনন্দবাজারে তার রিপোর্টও করেছি। কিন্তু কোনো দিন দেখিনি জনসংঘের কোনো নেতা বা কর্মী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছেন।
মোদির এ আত্মপ্রচার এবং ক্ষমতার দম্ভে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ সবাই উদ্বিগ্ন। সবার একটাই শঙ্কিত প্রশ্ন- এ দেশটাকে মোদি-শাহরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ক্ষমতা দখলই কি শেষ কথা? মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকবে না? থাকবে না সৌজন্যবোধ?
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]। সংগৃহীত:বিডিপ্রতিদিন
ছবি সংগৃহীত
২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’ বাংলাদেশকে বিনিয়োগের ‘উপযোগী’ হিসেবে ‘রেটিং’ দেওয়া শুরু করে। যেহেতু প্রথমবার রেটিং পায় বাংলাদেশ, মিডিয়ার আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
এরপর ২০১২ সালে বহুজাতিক বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাকস তার ‘নেক্সট ইলেভেন’ তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় বাংলাদেশকে বলা হলো ‘বিশ্বের উঠতি অর্থনীতির একটি’। এর পরপরই বিশ্বের শীর্ষ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক জেপি মরগ্যানের ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভে’র তালিকায়ও জায়গা পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০১৭ সালে আরেকটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্স ঘোষণা দিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৮তম বড় অর্থনীতি হবে। আর সেটাও হবে নাকি অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসের মতো শক্তিশালী অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে!
গার্মেন্টসের আয়, প্রবাসী আয়, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, একের পর এক চমক লাগানো মেগা প্রকল্প হচ্ছে, মিডিয়া উচ্ছ্বসিত, অর্থনীতিবিদেরাও খুশি।
অথচ কেউ জিজ্ঞেস করে না ‘নেক্সট ইলেভেন’, ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ এগুলো কী জিনিস? এগুলো আসলে কার কাজে আসবে? ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতির মানে কী? অর্থনীতি ‘২৮তম’ হলে গরিব মানুষেরা ঠিক কী সুবিধা পায়? মোটা চালের দাম কমে? আশুলিয়ায় ঘরভাড়া কমে? বাচ্চার দুধের খরচ দেয় সরকার? আর এই রেটিং এজেন্সিগুলো আসলে কারা? একেকটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে তাদের ভূমিকা কী? ভালো রেটিংয়ের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান বৃদ্ধির আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে?
রেটিং দেওয়া হয় মূলত বিনিয়োগকারীদের জন্য। বিদেশি ব্যাংক, বিদেশি কোম্পানি, বিপুল পরিমাণ অলস পুঁজি নিয়ে বসে আছে। তাদের দরকার নতুন দেশ, নতুন মার্কেট। বিদেশি বিনিয়োগকারী তো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। স্থানীয় মানুষের স্বার্থ রক্ষা হলো কি না, সেটা দেখা তার দায়িত্ব নয়। রেটিং ভালো মানে ব্যবসার ঝুঁকি কম। মানে সুদে–আসলে টাকা ফেরত আসবে। এজেন্সিগুলোর ‘রেটিং’ দেখেই ব্যাংক ঋণ দেয়, কোম্পানি বিনিয়োগ করে।
কিন্তু ভালো ‘রেটিং’ পেলেই কি উন্নয়ন হয়ে গেল? জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোকে আড়ালে রেখে বিদেশিদের রেটিং বা ব্র্যান্ডিং নিয়ে মাতামাতি শেষ পর্যন্ত কী ফল দিল? বেশি বেশি বিদেশি ঋণ নিয়ে ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের অবস্থাটা কী দাঁড়াল? অতিরিক্ত ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্পগুলোয় অর্থনীতির অবস্থা ভালো হয়েছে, না খারাপ হয়েছে? রূপপুর, মাতারবাড়ী, পায়রা বা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কি জনগণের ‘টার্মস’ মেনে হয়েছে? এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণকে পিষ্ট করা কেন?
প্রশ্নবিদ্ধ ঋণ, ক্ষতিকর প্রকল্প
একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ মেগা প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে, প্রতিটা মেগা প্রকল্পই একেকটা ঋণের ফাঁদ, অথচ আমাদের অর্থনীতিবিদেরা সরকারি লোকদের মতোই বলে গেছেন, আমাদের ঋণ-জিডিপির অনুপাত অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, তাই চিন্তা নেই। অথচ একের পর এক মেগা প্রকল্পের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত–বিধ্বস্ত প্রবাসী শ্রমিকের ঘাড়েই যে চড়তে হবে, সেই সতর্কবার্তা কি ছিল? মেগা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যে বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর, সেই বিশ্লেষণ কি ছিল?
৫১ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮৪ শতাংশই জাইকার ঋণ। ২১ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেলের ৭৫ শতাংশই জাইকার ঋণ। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার রূপপুর প্রকল্পের ৮০ শতাংশই রাশিয়ার ঋণ! ২০১৫ সালেও আমাদের নিট বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এখন হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। মাত্র ৮ বছরের মাথায় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২০ গুণ! এই বছর থেকেই বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ ২১ শতাংশ বাড়বে। ২০২৬ সাল থেকে শুধু রূপপুর কেন্দ্রটির জন্যই রাশিয়াকে পরিশোধ করতে হবে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা! অভ্যন্তরীণ ঋণ না হয় টাকা ছাপিয়ে শোধ করল, বিদেশি ঋণ কি ডলার ছাপিয়ে শোধ করবে?
কিন্তু এই সুদগুলো তো হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। ‘রেটিং ভালো’, ‘দেশ রোল মডেল হয়ে গেছে’—এসব দেশি–বিদেশি প্রচারণার পিঠে চড়েই তো দায়িত্বহীনভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর এসব প্রকল্পে লাগাতার ঋণ নেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধের পর ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, এমনকি শ্রীলঙ্কায়ও মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে, তেলের দামও কমেছে, শুধু আমাদের এই একটা দেশ, যেখানে গরিবের বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি জরুরি পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া বন্ধ হয়েছে, নতুন করে গরিব হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। ঋণের টাকায় বিলাসবহুল রোল মডেল তৈরি হয়েছিল, চীন, ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ বড়লোক বৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এখন কয়েক প্রজন্ম ধরে এই রোল মডেলের কিস্তিটা শোধ করবে কে? কম খাওয়া প্রবাসী শ্রমিক আর লোডশেডিংয়ে বিধ্বস্ত জনপদ?
‘ক্ষতিকর’ প্রকল্প বলা হচ্ছে কেন? কারণ, ঋণের টাকায় তৈরি প্রতিটা মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পই বিদেশি জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। শুধু রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতেই আগামী কয়েক দশক ধরে ১ কোটি টনেরও বেশি কয়লা আমদানি করতে হবে প্রতিবছর! ২০২৭ সাল নাগাদ বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি কয়লা আর এলএনজি আমদানি করতে হবে (দেখুন, ৫ বিলিয়ন ডলারই কষ্টসাধ্য, ২০ বিলিয়ন ডলারের সংস্থান হবে কি, বণিক বার্তা, ২০২৩)। অর্থাৎ এটা তো শুধু এক দফায় ঋণ করে ঘি খাওয়া না, বরং ঋণের টাকায় ঘি খাওয়ার রীতিমতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত!
অথচ প্রতিটি আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বিকল্প ছিল। সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বিকল্পই ছিল। ভারত এক দশকে আমাদের চেয়ে দুই শ গুণ বেশি সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ তৈরি করেছে। এদিকে অন্তত তিনটি আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান (ইউএসজিএস, এনপিডি ও র্যাম্বল) বিভিন্ন সমীক্ষায় জানিয়েছে, বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত ৩২ টিসিএফের ওপর (প্রায় ৩০ বছরের মজুত।)
পেট্রোবাংলা (২০২২) বলছে, ‘আমাদের মোট চাহিদার ৭৩ শতাংশ গ্যাস আসে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে, খরচ পড়ে মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা, আর সেখানে বাকি ২৭ শতাংশ গ্যাস (এলএনজি) বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, খরচ পড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা! তার মানে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ রেখে, সৌর-বায়ুবিদ্যুৎকে অবহেলা করে, ঋণের টাকায় কি সব বিদেশি কয়লা, বিদেশি এলএনজিনির্ভর প্রকল্প বানাচ্ছি আমরা!
শুধু তা–ই নয়, ঋণের টাকায় বানানো হয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ মুহূর্তে অলস বসে আছে ৯ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা (অর্থাৎ ঋণ নিয়ে যা বানিয়েছি, তার অর্ধেক অলস বসে থাকে।) এগুলোকে আবার বসিয়ে বসিয়ে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিতে হয়। এই টাকার বিপুল অংশ আবার পাচার হয়ে যায়। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে প্রতিটি প্রকল্পের উদ্ভট খরচ।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা (২০১৮) বলছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও অনেক বেশি (বৈশ্বিক গড় প্রতি কিলোওয়াটে ৫৫০ ডলার, বাংলাদেশের গড় খরচ ১ হাজার ডলার।) গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস’ বলছে, বাংলাদেশের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র (দেখুন, ‘মাতারবাড়ী কোল প্ল্যান্ট ইন বাংলাদেশ কস্টস এইট টু টেন টাইমস মোর দ্যান কম্পেয়ারেবল প্ল্যান্টস ইন চায়না’ ২০২২।) এদিকে বিশ্বব্যাংক (২০১৭) বলছে, এডিবির ঋণে তৈরি বাংলাদেশের ঢাকা-মাওয়া রুটটি পৃথিবীর মধ্যেই সর্বোচ্চ খরচের রাস্তা।
কৌশিক বসুদের ‘বুমিং’ বাংলাদেশ ও অর্থনীতিবিদদের দায়
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু নিউইয়র্ক টাইমস–এ কলাম লিখলেন: হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং? বসু বাংলাদেশের ‘বুম’–এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন গার্মেন্টস খাতের বিকাশকে। গার্মেন্টস খাত বিকশিত হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ‘বিকাশ’ কি টেকসই? গার্মেন্টসের কর্মসংস্থান কি দারিদ্র্য দূর করে? অক্সফাম (২০১৯) দেখিয়েছিল, পোশাকশ্রমিকদের ৯১ শতাংশই পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে পায় না। ৮৭ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। (দেখুন, মেইড ইন পোভার্টি, অক্সফাম, ২০১৯)
এই যে অটোমেশন গ্রাস করছে পোশাক খাতকে, গাজীপুর, আশুলিয়া, টঙ্গীতে নিয়মিত হাজারে হাজারে ছাঁটাই হচ্ছে, এই যে লাগাতার অর্থনৈতিক মন্দায় পশ্চিমের মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, এই যে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো কম মজুরিতে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করছে, এভাবে শুধু একটি-দুটি খাতকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভটি গড়ে ওঠার বিপদগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা কি সতর্ক করেন?
গার্মেন্টস আয়ের সীমাবদ্ধতা হলো, আয় করা ডলারের প্রায় অর্ধেক চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। পাঁচ বছর ধরে গার্মেন্টস আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ চলে গেছে শুধু সুতা আর ফেব্রিক আমদানি করতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, গার্মেন্টস মালিকদের টাকা পাচার (দুদকের অভিযোগ, ‘ওভার-ইনভয়েসিংয়ের’ মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করে শুধু বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মালিকরাই। দেখুন, দ্য নিউ এজ, ৩০ জানুয়ারি, ২০২১)। অর্থাৎ পোশাকশিল্প হচ্ছে সেই খাত যেখানে ডলার ঢোকে, আবার ডলার বেরিয়েও যায়।
খেয়াল করে দেখুন, বিদেশি কাঁচামাল, বিদেশি বাজার এবং বিদেশি কোম্পানির অর্ডারের ওপর নির্ভরশীল শিল্পটি বিশ্বব্যাংক ও তার সমচিন্তার অর্থনীতিবিদদের একচেটিয়া মনোযোগ পেয়েছে সব সময়। অথচ সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামালে তৈরি, দেশের ভেতরে দুর্দান্ত ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ’ তৈরি করা পরিবেশবান্ধব পাটশিল্প আর চিনিশিল্প নিয়ে তাদের বৈরী অবস্থান অবাক করার মতো। প্রশ্ন ওঠে, মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা উচ্চ ঝুঁকির বিদেশি ঋণ, বিদেশি কোম্পানি, বিদেশি ‘অর্ডার’ ও বিদেশি বিনিয়োগকেই উন্নয়নের একমাত্র পথ হিসেবে দেখাতে চান কেন? স্থানীয় শিল্প, পরিবেশবান্ধব শিল্প, গ্রামীণ অর্থনীতি, বা স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়া লাখো কর্মসংস্থান নিয়ে আগ্রহ দেখান না কেন? পোশাকশিল্পের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকের আয় নিয়ে গবেষণা করেন, কিন্তু ‘ম্যাক্রো’ অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গিয়ে শ্রমিক যে আজীবন দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরোতে পারে না, তা নিয়ে চুপ থাকেন কেন?
এই যে অর্থনীতিবিদেরা অতিরিক্ত ঋণের ঝুঁকি নিয়ে আগের থেকে সতর্ক করেন না, এই যে রেটিং এজেন্সিগুলোর অতি উৎসাহী রেটিং–এর ওপর ভিত্তি করে ঋণের পাহাড় তৈরি হয়, এগুলো কি সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা ঋণভিত্তিক মেগা প্রকল্প এবং প্রচুর পরিমাণে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক লেনদেনকেই ‘বাড়ন্ত অর্থনীতি’ হিসেবে দেখান? নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান কিন্তু ২০০৮–এর বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দায়ী করেছিলেন মূলধারার অর্থনীতিবিদদেরই। ফোর্বস ম্যাগাজিন দেখিয়েছিল, বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদেরা ২০০৮-এর অর্থনৈতিক ধসের কিছুদিন আগেও আমেরিকার অর্থনীতির ফুলেফেঁপে ওঠা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলেন (দেখুন, হাউ ইকোনমিস্টস কন্ট্রিবিউটেড টু দ্য ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস, ২০১২)
আরেক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ অর্থনৈতিক ধসের জন্য মূলত রেটিং এজেন্সিগুলোকেই দায়ী করেছিলেন। আমেরিকার ফিন্যান্সিয়াল ইনকোয়ারি কমিশন ২০০৮–এর বিপর্যয়ের কারণ তদন্ত করতে গিয়ে বলেছিল, এজেন্সিগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে ঋণ দেওয়াকে উৎসাহিত না করলে এই বিপর্যয় ঘটতই না। ক্রুগম্যান ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমস–এ লিখেছিলেন তাঁর বহুল আলোচিত কলাম—হাউ ডিড দ্য ইকোনমিস্টস গেট ইট সো রং? তাঁর ভাষায়, অর্থনীতির ফাঁপা বেলুনকেই ‘উন্নয়ন’ হিসেবে দেখানো অর্থনীতিবিদদের একটি পুরোনো সমস্যা।
আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য নয়, শিক্ষা নয়, স্থানীয় শিল্পায়ন নয়, মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি নয়, বৈষম্য দূরীকরণ নয়, বরং ঋণের টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থনীতির বেলুনটাকে নিয়েই এত দিন মাতামাতি করেছে সরকার। মেগা প্রকল্পে জিডিপি বেড়েছে, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মালিকের মুনাফা বেড়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ মাত্র শুরু হয়েছে, এখনই ডলারে কুলাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ঋণ শোধ করতে মধ্যবিত্তের গলায় পাড়া দিয়ে ট্যাক্স–ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হচ্ছে।
যুদ্ধের পর ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, এমনকি শ্রীলঙ্কায়ও মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে, তেলের দামও কমেছে, শুধু আমাদের এই একটা দেশ, যেখানে গরিবের বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি জরুরি পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া বন্ধ হয়েছে, নতুন করে গরিব হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। ঋণের টাকায় বিলাসবহুল রোল মডেল তৈরি হয়েছিল, চীন, ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ বড়লোক বৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এখন কয়েক প্রজন্ম ধরে এই রোল মডেলের কিস্তিটা শোধ করবে কে? কম খাওয়া প্রবাসী শ্রমিক আর লোডশেডিংয়ে বিধ্বস্ত জনপদ? সূত্র: প্রথম আলো
● মাহা মির্জা, লেখক ও গবেষক
ছবি: মুক্তসংবাদ প্রতিদিন
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় মালিবাগে বিএলডিপি কার্যালয়ে সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এক মত বিনিময় সভা সাবেক মন্ত্রী এম নাজিম উদ্দীন আল আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনডিপির চেয়ারম্যান শেখ মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা মহিবউল্যা শান্তিপুরী,জাতীয় মুক্তি দলের চেয়ারম্যান এটিএম মমতাজুল করিম, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পার্টির চেয়ারম্যান মির্জা আজম, বাংলাদেশ জনতা পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান,বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যান মোঃ হারুন অর রশিদ,বিএনডিপির চেয়াবম্যান শরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এসএম আমানুল্লাহ, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টির মহাসচিব এডঃ সরোয়ার মিয়া,জাতীয় মুক্তি দলের মহাসচিব আব্দুল আহাদ নুর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
সভায় দেশ ও জাতীর এই ক্রান্তিলগ্নে সমমনা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে শীঘ্রই "জাতীয় ঐক্য সমন্বয় পরিষদ" নামে একটি জোট আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় বক্তারা বৈষম্য বিরোধী ছাএ আন্দোলনের নবগঠিত রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, দেশের স্বাধীনতা একবারই হয়।২৪ ' র বিপ্লব আর স্বাধীনতা নিয়ে দেশে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র চলছে। এটা দেশের জন্য অমঙল বয়ে আনবে।