a
ফাইল ছবি । গোলাম মাওলা রনি
শিরোনামের প্রবাদবাক্যটি কে রচনা করেছিলেন আমার জানা নেই। তবে আমাদের দেশের হাটে-ঘাটে-মাঠে তো বটেই এমনকি অন্দরমহলের একান্ত আলোচনাতেও প্রবাদটি এত বেশি আলোচিত হয় যার কারণে এটি এখন আবু বঙ্গালা অথবা মুঞ্জালাদের দেশে যেন সর্বাধিক উচ্চারিত বেদবাক্যে পরিণত হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় যে পরাজিত হয় সে কাঙাল প্রজারূপে নিজেকে রাজার আসন থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে স্বেচ্ছায় এবং সব দায়-দায়িত্ব বিজয়ীর ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে রাজা বানিয়ে অভিসম্পাত করতে গিয়ে বলে ওঠে, রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়! স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্যান্য সম্পর্ক বা শ্রেণীপেশার লোকজন যখন স্বার্থের সঙ্ঘাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তখন হাজারো ঐতিহ্যবাহী গালিগালাজের পাশাপাশি ভদ্র ভাষায় যে অভিসম্পাত দেয়া হয় সেগুলোর মধ্যে আজকের শিরোনামের প্রবাদ বাক্যটিই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।
রাজা কে- অথবা প্রজা কে কিংবা রাজার কোন দোষে প্রজা কষ্ট পায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে দুটো শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। প্রথম শব্দটি হলো- আবু বঙ্গালা। মধ্যযুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিনহাজ উস সিরাজ তার তুযুকে ফিরোজশাহী গ্রন্থে আবু বঙ্গালা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুখলক যখন বাংলায় এসেছিলেন বিদ্রোহ দমনের জন্য, তখন তার সাথে মিনহাজ উস সিরাজও ছিলেন। তখনকার দিনে যারা বাঙালিদের নেতৃত্ব দিতেন তাদের আবু বঙ্গালা অর্থাৎ বাঙালিদের পিতা বলা হতো। মিনহাজ উস সিরাজের মতে- তখন বাংলা প্রদেশে শত শত আবু বঙ্গালা ছিল যারা মূলত গোত্রপতি এবং জায়গিরদার বা সরকারের পক্ষে খাজনা আদায়কারীরূপে আখ্যায়িত হতেন। তারা যোদ্ধা ছিলেন এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নির্ধারিত সংখ্যক সৈন্য পুষতেন।
আবু বঙ্গালারা জায়গীর লাভ করতেন দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে। সুতরাং সম্রাটের প্রয়োজনে তারা তাদের পোষ্য সৈন্যসহ সম্রাটের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিজর্সন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। এমনকি সম্রাট যদি তার নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন সে ক্ষেত্রে নিয়ম মোতাবেক আবু বঙ্গালারা সম্রাটের বাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যুদ্ধ করতেন এবং এটাই শত শত বছর ধরে চলে আসছিল সারা ভারতবর্ষে। তবে ভারতের অন্যান্য অংশের জায়গিরদাররা যেভাবে দিল্লির প্রয়োজনে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন তা কিন্তু প্রায়ই বাংলায় এসে উল্টো রূপ ধারণ করত। অর্থাৎ আবু বঙ্গালারা সুযোগ পেলেই কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত এবং কোনো প্রাদেশিক গভর্নর যদি বিদ্রোহ করত তবে তারা নিয়োগকর্তার অবদান ভুলে বিদ্রোহীর পক্ষ অবলম্বন করত।
আবু বঙ্গালাদের উল্লেখিত চরিত্রের কারণে দিল্লির নিযুক্ত গভর্নররা এ দেশে এসেই স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং প্রায়ই বিদ্রোহ করে বসতেন। দিল্লির সুলতানি আমল থেকে শুরু করে মোঘল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। ফলে বাংলার ঘন ঘন বিদ্রোহ নিয়ে দিল্লিকে তটস্থ থাকতে হতো। মিনহাজ উস সিরাজ যে সময়ের কথা বলছেন সেটা সম্ভবত ১৩৫৩ সাল ছিল। মিনহাজের মতে দিল্লির কেন্দ্রীয় বাহিনী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলো তখন আবু বঙ্গালারা তাদের সৈন্য সামন্তসহ ফিরোজ শাহ তুঘলকের পক্ষ ত্যাগ করে গভর্নর ইলিয়াস শাহের পক্ষ নিলো। ইলিয়াস বারবার চেষ্টা করছিলেন আত্মসমর্পণ করার জন্য। কিন্তু আবু বঙ্গালারা তাকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করতে থাকল। ফলে একটি অসম যুদ্ধে ইলিয়াস শাহের পরাজয় ঘটল এবং হাজার হাজার বঙ্গালা সৈন্য মারা পড়ল।
আবু বঙ্গালাদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার মুঞ্জালা শব্দ নিয়ে কিছু বলি। এটি একটি চৈনিক শব্দ। চীন দেশে অন্তত হাজার খানেক জনপ্রিয় চীনা ভাষা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মান্ডারিন এবং ক্যান্টনিজ ভাষায় সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনা কথা বলে। এই দুটি ভাষার বাইরে গুয়ানিজ এবং সাংহায়ানিজ ভাষাও অত্যন্ত জনপ্রিয়। গুয়াংসু প্রদেশের বেশির ভাগ লোকের কথ্য ভাষার নাম গুয়ানিজ। অন্য দিকে বৃহত্তম সাংহাই এলাকার লোকজন সাংহায়ানিজ ভাষায় কথা বলে। আজকের নিবন্ধে আমি যে মুঞ্জালা শব্দের কথা বলছি তা মূলত সাংহাই অঞ্চলের শব্দ। এই এলাকার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লোকজনকে মুঞ্জালা বলে ডাকে। আপনি যদি কখনো ওই এলাকায় যান তবে তারা আপনাকে বাংলাদেশীর পরিবর্তে মুঞ্জালা বলে সম্বোধন করবে। সাংহাই বিমানবন্দরে বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখামাত্র ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা ফিসফাস করে মুঞ্জালা মুঞ্জালা বলে আরো কিসব কথাবার্তা তাদের সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করে এবং পাসপোর্টটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পরখ করতে থাকে।
ব্যবসায়িক কাজে আমাকে একটা সময় খুব ঘন ঘন চীন যেতে হতো। আমি সাধারণত ঢাকা থেকে সরাসরি হংকং যেতামÑ তারপর সেখানকার কাজ সেরে সোজা সাংহাই যেতাম। তারপর অভ্যন্তরীণ রুট ব্যবহার করে চীনের অন্যান্য শহর-বন্দরে যেতাম। এর বাইরে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক অথবা কুয়ালালামপুরে কাজ থাকলে সেখান থেকেও সরাসরি সাংহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতাম এবং প্রত্যেকবারই লক্ষ্য করতাম যে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমার পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে ১০-১২ মিনিট ধরে নাড়াচাড়া করত এবং একটু পরপর আমার দিকে তাকাত। এরপর মাইক্রোফোনে চীনা ভাষায় যেন কিসব বলত যার মধ্যে শুনতে শুনতে আমি মুঞ্জালা শব্দটি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আমি আমার স্বাভাবিক কমনসেন্স দ্বারা অনুধাবন করতাম যে, আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তারা আমার গতিবিধি এবং মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে, ডেস্কে বসা কর্মকর্তাটি আমার পাসপোর্টের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত হয়তো তার কর্তৃপক্ষকে জানাত।
আমাকে কোনো দিন অন্য কোনো চীনা বিমানবন্দরে জিজ্ঞাসাবাদ তো দূরের কথা এমনকি কোনো প্রশ্নও তারা করেনি। কেবল সাংহাই বিমানবন্দরে উল্লিখিত উপায়ে কালক্ষেপণ করাত। এ অবস্থায় আমার মনে প্রশ্ন জাগল ওরা কেন বাঙালিদের দেখলে মুঞ্জালা মুঞ্জালা বলছে এবং বেশির ভাগ বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীকে হয়রানি করছে। এ অবস্থায় সাংহাইতে আমাদের কোম্পানির এজেন্ট রিচার্ডকে বিষয়টি বললাম। কিন্তু সে কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। এরপর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মুঞ্জলা শব্দের অর্থ কি। সে আমার কথা শুনে কিছুটা বিব্রত হলো এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করল প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যখন নাছোড়বান্দার মতো তাকে চেপে ধরলাম তখন সে জানাল যে মুঞ্জালা অর্থ বোকা বা নির্বোধ মানুষের দেশ। এ ঘটনার পর আমি আর কোনো দিন সাংহাই বিমানবন্দর দিয়ে ইন করিনি। আবু বঙ্গালা এবং মুঞ্জালা নিয়ে বহু মজার কাহিনী এবং অনেক ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। কিন্তু আমি ওদিকে না গিয়ে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাই। আবু বঙ্গালাদের কারণে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে সাধারণ জনগণের দুঃখ দুর্দশা বা কষ্টের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। অধিকন্তু আমাদের দেশকাল সমাজে আবু বঙ্গালা প্রবৃত্তির নেতা পাতিনেতা চামচা ও সুবিধাভোগীদের আধিক্য এবং তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে যুগ যুগ ধরে আমজনতা নির্যাতিত নিপীড়িত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। ফলে আমাদের গড়পড়তা সাধারণ বুদ্ধি বা কমনসেন্স কমতে কমতে রীতিমতো তলানিতে ঠেকেছে। তা ছাড়া আমাদের সেন্স বা মানসিক সুস্থতার সূচকও অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্নগামী। আমরা যদি আমাদের সেনসিবিলিটি বা অনুভব শক্তি অর্থাৎ মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তি আবেগ এবং সংবেদনশীলতাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতার কথা বিবেচনা করি তবে জাতিগতভাবে লজ্জিত হতে হবে।
আমরা যদি আমাদের সেন্স অব হিউমার বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব যে, এই অসাধারণ মানবিক গুণটি স্থূল হতে হতে রীতিমতো গর্ভবতী গর্দভ বা গন্ডারের পেটের মতো হয়ে গেছে। আমাদের সেনটিমেন্ট বা হৃদয়ানুভূতি কবে যে সেন্সলেস অর্থাৎ নির্বোধ, মূঢ় বা অর্থহীন হয়ে পড়েছে তা বোঝার জন্য মুঞ্জালা শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা সংবলিত চৈনিক টিকা গ্রহণের বিকল্প নেই। উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি রাজা এবং প্রজার সমীকরণ করতে চাই তবে দেখতে পাবো যে, আবু বঙ্গালা প্রকৃতির নেতৃত্ব থাকলে প্রজাদের দুর্ভোগ যেমন বাড়ে তেমনি প্রজারা এক সময় মানবিক গুণাবলি হারিয়ে মুঞ্জালার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এমন অবস্থায় প্রজাদের ওপর প্রকৃতিগতভাবেই নিকৃষ্ট রাজা চেপে বসে। আর নিকৃষ্ট রাজার অদ্ভুত সব পাগলামো এবং নির্বুদ্ধিতা কিভাবে প্রজাদের জীবনকে জাহান্নামে রূপান্তর করে ফেলে তার কিছু পরোক্ষ উদাহরণ আমরা মিনহাজ উস সিরাজের তুযুকে ফিরোজশাহীতে এবং ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্তে পেয়ে যাবো।
ইতিহাসের পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে, আমাদের রাজনীতি অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যখন মারাত্মক কোনো অসঙ্গতি অনিয়ম এবং আজব তামসার ঘটনা ঘটে তখন আমরা সাধারণত সেটিকে তুঘলকি কাণ্ড বলে থাকি। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের কয়েক হাজার বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি যদি বিচার বিশ্লেষণ করা হয়, তবে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং পরে ফিরোজ শাহ তুঘলকের জমানায় যেসব পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটেছে তার সাথে অন্য কোনো রাজা বাদশাহদের রাজত্বকালের তুলনা চলে না। এই দুই তুঘলকি শাসকের কারণে রাজধানী দিল্লি দুইবার বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। মুহাম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তর করতে গিয়ে ভারতের অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটিয়েছেন এবং প্রচণ্ড রক্তপাত নিষ্ঠুরতা ও অহেতুক যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে লাখ লাখ লোকের প্রাণ সংহার করেছেন। তিনি রাজনীতি সিংহাসন এবং রাজপ্রাসাদকে এতটাই ভয়ঙ্কর বানিয়ে ফেলেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর কেউ সুলতান হতে চায়নি এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই একমাত্র বিরল ঘটনা যে ভারতবর্ষের মতো বৃহত্তম সাম্রাজ্যের সম্রাটের মৃত্যুর পর কেউ সিংহাসনে বসতে চায়নি- ফলে পুরো তিন দিন সিংহাসন খালি ছিল।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যের আমির-ওমরাহ, আলেম-ওলামা এবং উজির-নাজিররা একরকম জোর করে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চাচাতো ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলককে সিংহাসনে বসান ১৩৫১ সালের ২৩ শে মার্চ। তিনি প্রায় ৩৭ বছর রাজত্ব করেন। কিন্তু আশা আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছার বিপরীতে পাওয়া বিশাল সাম্রাজ্যটিকে তিনি আল্লাহর মাল দরিয়ায় ঢাল এইরূপ মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি বাংলা ও উড়িষ্যা ছাড়া অন্য কোনো অঞ্চলে যুদ্ধাভিযান চালাননি। ফলে দিল্লি শাসিত অঞ্চলের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায়। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াতেন না। কাউকে ক্ষেপাতেন না। উল্টো আলেম ওলামা সেনাপতি কোতোয়ালদের তোয়াজ তদবির করতেন। তিনি অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন কিন্তু রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি কুশাসন ও অবিচার অনাচারের জন্য সর্বকালের ইতিহাস ভঙ্গ করেছেন। তার আমলে যে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি হতো অমনটি মানবজাতির ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্র কোনো কালে ঘটেনি। কথিত আছে সুলতান নিজে তার কর্মচারীদের কাছ থেকে কাজ আদায়ের জন্য গোপনে ঘুষ দিতেন।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের কারণে কেবল দিল্লির সিংহাসন নয় পুরো ভারতবর্ষের রাজনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলার আবু বঙ্গালারা দলে দলে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ মুঞ্জালাদের নিয়ে দিল্লিতে আসর জমাতে থাকেন। এভাবেই ৩৭টি বছর পার হয়। সুলতানের মৃত্যুর পর তার দুর্বল উত্তরাধিকারীরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে তুঘলকি রাজ্যের প্রজাদের জীবনে যে নরক যন্ত্রণা চলছিল তাতে ঘি ঢেলে দেয়ার জন্য বিশ্ববিখ্যাত বিজেতা তৈমুর লং দিল্লি আক্রমণ করেন এবং দিল্লিকে নরককুণ্ড বানিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিরানভূমিতে পরিণত করেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য/সূত্র: নয়া দিগন্ত
সংগৃহীত ছবি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, হেফাজতকে কোনো হরতাল করতে দেওয়া হবে না। শুক্রবার রাতে সংবাদ মাধ্যমকে এসব কথা জানান তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডবের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে, শুক্রবার রাত ৮টায় পুরানা পল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশে শনিবার (২৭ মার্চ) বিক্ষোভ ও রবিবার (২৮ মার্চ) হরতালের ঘোষণা দেয় হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী।
উল্লেখ্য, শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পাশাপাশি জলকামানও ব্যবহার করা হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ফাইল ছবি
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পরপরই পশ্চিমা দেশগুলোর নজীরবিহীন অবরোধের মুখে পড়ে রাশিয়া। ফলে বন্ধ হয়ে যায় দেশটির বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
তবে রাশিয়ার এই দুঃসময়ে এগিয়ে আসে চীন। রাশিয়ার দক্ষিণের এই প্রতিবশী আগেই ঘোষণা করেছিল যে দুই দেশের বন্ধুত্বের মধ্যে ‘কোনো সীমা নেই’। ফলে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বের করে দেওয়ার যে মারাত্মক প্রভাব রাশিয়ার ওপর পড়ার আশঙ্কা ছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে।
সিএনএন মতে, দুই দেশের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও একবার সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই গত সপ্তাহে চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মস্কোয় সাক্ষাৎ করেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে বলেছে যে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগামী এপ্রিল কিংবা মে মাসের শুরুর দিকে মস্কোতে একটি শীর্ষ বৈঠকে বসতে পারেন।
চীন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পণ্যক্রেতা। অর্থ এবং প্রযুক্তির একটি শক্তিকেন্দ্রও এই দেশ। ফলে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাশিয়ার দিকে চীনের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মানেই হলো দেশটির অর্থনীতি ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া। তিনটি উপায়ে চীন এই কাজ করছে।
রাশিয়ার জ্বালানি কিনে নেওয়া:
মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের একটি বড় অস্ত্র ছিল রাশিয়ার তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং এরপর তেলের দাম বেঁধে দেওয়া। এর বাইরে ছিল বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার এবং দেশের বাইরে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করা।
এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের অর্থায়নে রাশিয়ার সক্ষমতা দুর্বল করে ফেলা।
এর প্রভাব কিন্তু ঠিকই পড়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতি ২০২২ সালে মন্দার কবলে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের সবশেষ হিসাব বলছে, দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ওই বছরে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যায়।
কিন্তু এই সময়ে উল্টো মস্কোর রাজস্ব বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার সরকার। আর এর কারণ হলো, জ্বালানির উচ্চ মূল্য এবং চীন ও ভারতের মতো ক্রেতা, যারা রাশিয়ার তেল কিনতে আগ্রহী, তাদের কাছে তেল বিক্রির ফলে পাওয়া পয়সা।
ইউরাশিয়া গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক নিল টমাস বলেন, ‘আমরা বলতে পারি, রাশিয়ার যুদ্ধকে আর্থিকভাবে সমর্থন করেছে চীন। তারা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য জোরদার করার ফলে মস্কোর সামরিক শক্তি কমানোর পশ্চিমা চেষ্টা শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।’
নিল টমাস আরও বলেন, ‘সি চিন পিং আরও বেশি একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চান।’ তাঁর মতে, মস্কোর এই অবস্থার কারণে চীনের পক্ষে সস্তায় রাশিয়ান তেল কেনা, আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি সংগ্রহ করা এবং নিজেদের আন্তর্জাতিক স্বার্থের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন জোগাড় করা সহজ হয়েছে।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ২০২২ সালে বাণিজ্য নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। এই বছরে দুই দেশের মধ্যে ১৯ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জ্বালানি তেলের ব্যবসা। গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে ৫ হাজার ৬০ কোটি ডলারের অপরিশোধিত তেল কেনে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি। এই সময়ে চীন এক হাজার কোটি ডলারের রুশ কয়লা আমদানি করে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৪ শতাংশ।
তবে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে পাইপলাইনের মাধ্যমে পাওয়া গ্যাস এবং তরলীকৃত গ্যাসের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এই সময়ে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে ৯৬০ কোটি ডলার দিয়ে এই দুটো পণ্য কেনে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫৫ শতাংশ বেশি।
দুই দেশই এসব কেনাকাটা থেকে লাভবান হয়েছে। রাশিয়ার প্রয়োজন ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য নতুন গ্রাহক। আর চীনের দরকার ছিল সস্তায় জ্বালানি, বিশেষ করে যখন তার অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ছিল।
চীন ও রাশিয়া এখন তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণ করতে পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার গ্রাজপ্রম এবং চীনের ন্যাশনাল প্রেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে একটি চুক্তি, যার আওতায় রাশিয়া আগামী ২৫ বছর চীনের কাছে আরও বেশি গ্যাস সরবরাহ করবে।
পশ্চিমা আমদানির বিকল্প:
চীনের কাছে তেল বিক্রি যেমন চলছে, তেমনই রাশিয়াও চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিকস, বিভিন্ন ধরনের ধাতু, যানবাহন, জাহাজ এবং উড়োজাহাজ কিনছে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের করা এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ইউরাশিয়া গ্রুপের নিল টমাস বলেন, চীন যদিও যুদ্ধে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন জানায়নি, তারপরও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েই চলবে। কারণ, বেইজিং আসলে সুযোগসন্ধানী।
অন্যদিকে, রাশিয়ারও গাড়ি কিংবা ইলেকট্রনিকসের মতো পণ্যের জন্য বিকল্প উৎস দরকার হয়ে পড়েছিল। তারা আর পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এগুলো কিনতে পারছিল না।
আর এ ক্ষেত্রে চীনকে টেক্কা দেওয়ার সামর্থ্য খুব কম দেশেরই রয়েছে, কারণ চীনের রয়েছে বিশাল উৎপাদনব্যবস্থা’, বলেন মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের সহযোগী অধ্যাপক আনা কিরিভা।
রাশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটোস্ট্যাটের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, পশ্চিমা বিভিন্ন গাড়ির বিক্রি বন্ধ হওয়ার পর দেশটিতে চীনের ব্যান্ড হ্যাভেল, চেরি এবং গিলির বিক্রি এক বছরে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই হার আগামী সময়ে আরও বাড়বে বলেই পূর্বাভাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২১ সালে রাশিয়ার স্মার্টফোনের বাজারের ৪০ শতাংশ ছিল চীনা ব্র্যান্ডের হাতে। এক বছর পর রাশিয়ার স্মার্টফোনের বাজার এখন বলা যায় পুরোটাই চীনের দখলে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট বলছে, রাশিয়ার বাজারের ৯৫ শতাংশ স্মার্টফোনই চীনের তৈরি।
মার্কিন ডলারের বিকল্প:
সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার পর ডলার বাদ দিয়ে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করা শুরু করে মস্কো।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার কোম্পানিগুলো আরও বেশি করে ইউয়ান ব্যবহার করছে। আনা কিরিভা বলছেন, অবরোধ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে রাশিয়ার ব্যাংকগুলো আরও বেশি লেনদেন এখন ইউয়ানে করছে।
মস্কো এক্সচেঞ্জকে উদ্ধৃত করে রাশিয়ার গণমাধ্যম জানাচ্ছে যে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ইউয়ানের লেনদেন ছিল এক শতাংশের কম, সেখানে নভেম্বরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশে।
সুইফটের তথ্য বলছে, গত জুলাই মাসে যে তিনটি দেশে ইউয়ানের কেনাবেচা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল, রাশিয়া ছিল তাদের একটি। বাকি দুটো ছিল হংকং এবং যুক্তরাজ্য। সেই থেকে এখনো রাশিয়া প্রথম ছয়টি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে রাশিয়া শীর্ষ ১৫ দেশের মধ্যেও ছিল না।
রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ইউয়ানের রিজার্ভ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে। বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, ২০২৩ সালে রাশিয়া শুধু ইউয়ান কিনবে। আনা কিরিভা বলছেন, আগামীতে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্য আরও বেশি ডলারবিহীন হবে।
তবে চীন–রাশিয়ার এই অর্থনৈতিক সম্পর্কে যে একেবারে কোনো ঠোকাঠুকি নেই, তা বলা যাবে না।
খবর পাওয়া গেছে যে চীনের লেনদেনব্যবস্থা ইউনিয়নপে রাশিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে ইস্যু করা কার্ড গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার সংবাদপত্র কোমারসান্ত বলছে, এটা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অবরোধে পড়ার ভয় থেকে। সূত্র: প্রথম আলো