a
ফাইল ছবি
দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অবশেষে ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে উদ্ভোধন হলো আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির মহাকাব্যিক গেম চেঞ্জার পদ্মা সেতু।পদ্মা সেতু কেবল একটি ইট - পাথরের অবকাঠামো নয়, এটি বাঙালির বিজয়, আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা, অহংকার, গর্ব ও সক্ষমতার প্রতীক। ষড়যন্ত্র পদদলিত করে বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর স্তম্ভ । সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় - জলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন 'আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না' । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্ভোধনের মধ্যদিয়ে জাতির পিতা আর সুকান্তের কথার আবারও প্রমাণ দিয়ে উচ্চারণ করলেন "যতবারই হত্যা করো জন্মাবো আবার, দারুণ সূর্য হবো লিখবো নতুন ইতিহাস "।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির ট্রাম্প কার্ড স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্ভোধনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতেও পদ্মা সেতু নতুন গেম চেঞ্জার হবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সে বাধার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এডিবি, আইডিবি ও জাপানের জাইকা। অথচ পদ্মা সেতু উদ্বোধনে সেই তারা ও বিশিষ্টজনেরা কী বলে একটু দেখে নিই :
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে বিবৃতি হলো " পদ্মা সেতুর নির্মাণসাফল্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের উন্নয়নে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ‘উদাহরণ’ "।
অন্যদিকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প সঠিকভাবে সম্পন্ন করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেম্বন।
শুধু তাই না জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, " পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থায়নে। এটা স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় স্থিতির মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক কিছুই করতে পারে এবং পদ্মা সেতু সেই সক্ষমতার জানান দিয়েছে "।
ভিডিও বার্তায় চীনা রাষ্ট্রদূত নিজস্ব অর্থে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণে সাহসিকতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘সেতুটি আমার কাছে সাহসের একটি প্রতীক। স্বল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশ এমন সেতু নির্মাণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ সেতুটি শুধু বাস্তবায়নই হয়নি, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এর শতভাগ নির্মিত হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে যদি সাহসের কোনো সীমা না থাকে, তবে আকাশ তার সীমা।’
অপরদিকে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বাংলাদেশে নিযুক্ত হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন 'বাংলাদেশের গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ '।
ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন " পদ্মা সেতু দক্ষিণ অঞ্চলে মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো আর সেটার সফল বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ "
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বের প্রতিফলন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন। এই সেতু আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় ও সুসংহত করবে।’
পদ্মা সেতু উদ্বোধন ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে খানিকটা এগিয়ে নিল কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের সিদ্দিকী বলেন, নিশ্চয়ই নেবে। কেউ কাজ করলে সে অগ্রসর হবে না কেন।
বর্তমানে আওয়ামীলীগের কট্টর সমালোচক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আজকে জাতির এই সাহসী উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। অত্যন্ত আনন্দঘন অনুভূতি এটা। একাত্তরেও মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি। আজকে পদ্মা সেতু নিজের চোখে দেখতে পেরেছি। এটি আমার জীবনের বড় একটি আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়ে গেছে। উনি অনেক ভালো কাজ করেছেন। এখন উনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর ( অব) আকতার বলেন - বেগম খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে পারতেন। এতে ইতিবাচক জনমত তৈরি হতো বলেই আমি বিশ্বাস করি ।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন - যারা নিজস্ব জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে এবং নাম শুনতে পারে না, তাদের একটি অংশও আজ বলতে বাধ্য হচ্ছে, শেখ হাসিনা সত্যি পেরেছেন, তিনি পারেন। জাতীয় নেতৃত্বের বিশাল স্বীকৃতি। দক্ষিণ অঞ্চলের ২১ জেলায় যাঁরা বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মী রয়েছেন, তাঁদের মুখেও শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ এই পদ্মা সেতু করতে পারতেন না। সুতরাং আগামীর রাজনীতিতে এর একটি প্রভাব থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।
পদ্মা সেতু ভৌগলিকভাবে খণ্ডিত বাংলাদেশকে একসঙ্গে করেছে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য পদ্মা সেতু ভীষণ জরুরি ছিল বলে মনে করে পদ্মা সেতুতে কারিগরি টিমে কাজ করা নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তিনি আরো বলেন বিশ্ব ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। দূর্নীতি হলে সেটার দায়ভার আমার আর ড.জামিলুর রেজা চৌধুরীর হতো।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক বলেন -
কূটনীতিতে পূর্বানুমান অনুসারে ভূরাজনীতির ঘুঁটির বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার প্রতিপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। পদ্মা সেতুর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনা চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতুর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত জটিল। তাই এ সেতু নিয়ে চীনের উচ্ছ্বাস ভিন্ন মাত্রার।
গণতন্ত্রে জনগণই হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। বিভিন্ন রকম নানাবিধ সমস্যা পরও আওয়ামীলীগ সরকার এক পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের সিংহ ভাগ মানুষের সমর্থন এবং সহমর্মিতা আদায় করেতে সক্ষম হয়েছে। সে কারণেই পদ্মা সেতু জাতীয় রাজনীতির মাঠে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এই আবেগ, উচ্ছ্বাস- ও আনন্দের কারণে বিরোধী দল হঠাৎ করে এখন যেমন আন্দোলনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে না, তেমনি ভূ-রাজনীতির খেলোয়াড়েরা বিপুল জনসমর্থনে থাকা এই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম চাপ প্রয়োগ করেও খুব একটা সফল হতে পারবে বলে মনে হয় না। ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তি যে বড় শক্তি, সেটি পদ্মা সেতু আবারও প্রমাণ করেছে। এই সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্বাস করতে শিখেছে যে, শেখ হাসিনা যা বলেন তা পালন করেন। ফলে আগামী রাজনীতিতে পদ্মা সেতু একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে দাঁড়াবে।
প্রমত্ত পদ্মায় সেতু নির্মাণ শুধু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেই না আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও এর প্রভাব অপরিসীম হবে। এ সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির দাবার চাল যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের দিকে গমন করতে পারে বলে মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ।
ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় ‘দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার সেতু’। বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের সুতিকাগার ইউরোপ নয়, বরং এশিয়া। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হলো এশিয়া এবং অত্র অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান একবারে কেন্দ্র পর্যায়ে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন মানেই হচ্ছে এশিয়ার উন্নয়ন। সাম্প্রতিক সময়ে বুঝা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগীতা- প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়ে উঠেছে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি ‘উন্নয়ন হাব’ হিসেবে যদি পদ্মাসেতুর গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশ হিসাবে নিজেদের সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে তাহলে সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের ভুমিকায় থাকবে এই পদ্মা সেতু।
গত এক দশকে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে চীনকেন্দ্রিক নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে । পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক রাজনীতিতে চীন প্রথমেই বিশ্বব্যাংককে হারিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরাজয় মানে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রেরই পরাজয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে পিছিয়ে গেল।
রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির মেরুকরণ ও সমীকরণ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হচ্ছে। চীন-ভারতের সম্পর্কে বরফ গলা শুরু হয়েছে। টাইমস নার্ড নামের ভারতের একটি জনপ্রিয় সংবাদ চ্যানেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সমস্যা রয়েছে, তবে সেটি দেখভাল করার জন্য ভারত একাই যথেষ্ট, অন্য কারো সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন নেই। ’ এটিকে চীন - ভারতের সুসম্পর্ক হিসাবেও অনেকে ইঙ্গিত করেছেন। চীনও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে।
জয়শঙ্কর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন - ইউরোপের সমস্যাকে ইউরোপবাসী বিশ্বের সমস্যা মনে করে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য সমস্যাকে ইউরোপ নিজেদের সমস্যা মনে করে না। তিনি আরো বলেছেন, আগামী দিনে ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন হবে, যে কথা চীন বহু আগে থেকেই বলে আসছে।
এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে চীন-ভারত সম্পর্কের মধ্যে সুঘ্রাণের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, এই সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকলে পুরো এশিয়া অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক আবহাওয়ার বিশাল পরিবর্তন ঘটবে। সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে পড়বে পদ্মা সেতুর ওপর।
সুতরাং পদ্মা সেতুর যেমন অভ্যন্তরীণ গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব।
অনেক ষড়যন্ত্র ও হাজারো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ, দূরদর্শী, চৌকশ নেতৃত্বের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর উদ্ভোধন বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট মহাকাব্য। এই মহাকাব্যিক অর্জন বিশ্বরাজনৈতিক পরিমন্ডলে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অনন্য মর্যাদায়-অনন্য উচ্চতায়। মর্যাদার এই আসন সমুন্নত রেখে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্রতিটি পথচলায় লাল-সবুজের এই মহাকাব্যিক অগ্রযাত্রাকে উঁচিয়ে ধরে নায্য অধিকার আদায়ের জন্য দল,মত নির্বিশেষে সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
লেখকঃ ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
সভাপতিঃ সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
(লেখকঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পাঠ্য বই)
ছবি:ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
এই ভ্যাপসা গরমে লোডশেডিং এ অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, এরফলে দুর্বিষহ জনজীবন। কয়েকদিন ধরে পত্রিকার পাতায় ও টিভি চ্যানেলে দেশের সর্বত্র লোডশেডিং এর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকার বলছে, গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নত হতে পারে, সে ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। কিন্তু এর প্রতিকার কি?
২০১১ সাল পর্যন্ত এই দেশে ঘরবাড়িতে বিদ্যুতের অভাবে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকতো, লোডশেডিং ছিল নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। অনেকের কাছে তা ছিল দুঃসহ স্মৃতির মতো। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্যে মানুষ লোডশেডিং শব্দটি ভুলেই গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে দেশ আবার লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ছেয়ে গেল কেন? হ্যাঁ, এ ব্যাপারে বিশ্ব পরিস্থিতির দায় আছে, কিন্তু এর বাইরে কি আর কারোর কোনো দায় নেই? বলা বাহুল্য, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২-২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও চাহিদা মাত্র ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট। তাই অনেকের প্রশ্ন সক্ষমতা সত্ত্বেও লোডশেডিং কেন?
আসলে দেশে সর্বশেষ হিসাব মতে - ২০০৮-০৯ সালে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও তখন উৎপাদন হতো মাত্র ৪ হাজার মেগাওয়াট অর্থাৎ ঘাটতি থাকতো প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ২০২২ সালে এসে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা মত প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করার মত কাঁচামালের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ফলে ১-২ ঘন্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। কারণ বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন বেড়ে গেছে। এর প্রধান কারণ প্রায় ৮৫% বিদুৎ কেন্দ্র গ্যাস ও তেল নির্ভর বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি বলেন, ধৈর্য্য সহকারে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র, যাদের অনেক টাকা পয়সা আছে, তারাও লোডশেডিংয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে, জাপানে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে বরাদ্দ থাকা সত্বেও, ব্যাংকে অর্থ থাকা সত্বেও সংবরণ করছে।
'যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি,
আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপভাতি।’
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতার মত -দিনের বেলা প্রদীপ জ্বালানো মানুষকে পরবর্তীতে প্রয়োজনের সময় অন্ধকারেই সময় কাটাতে হয়। ঠিক তদ্রুপ দুঃসময়েও যে জাতি কারণে-অকারণে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ মৌলিক চাহিদাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় না করে মিতব্যয়ী হবে সেই জাতিই সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে উপনীত হবে। বস্তুত অপব্যয়ই অভাব নিয়ে আসে।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার বিদ্যুৎ। চোখ বন্ধ করে একবার চিন্তা করে দেখলে বুঝতে পারবেন বিদ্যুৎ ছাড়া কিছুই সম্ভব না, আর সেই মূল্যবান বিদ্যুৎ সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমরা অহরহ অপচয় করি। এক ঢাকা শহরে যদি তিন দিন বিদ্যুৎ না থাকে কেমন হবে ভাবুনতো? - বিদুৎ না থাকলে লিফট চলবে কি?
জেনারেটর দিয়ে কয় ঘন্টা বেক-আপ দিবেন? শুধু তাই না - বিদুৎ না থাকলে উৎপাদন কমে যাবে - ফলে জিনিসের দাম বেড়ে যাবে, এর ফলে আয়ের সাথে ব্যয়ের অনেক পার্থক্য হওয়ায় জীবনযাত্রা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। শুধু কি তাই, বিদ্যুৎ না থাকলে অনলাইন ভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ হলে অর্থনৈতিতে স্থবিরতা দেখা দিবে।
সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও লোডশেডিং মানেই হলো বিদ্যুৎখাতের 'উন্নয়ন' দর্শনে বড় রকমের ত্রুটি রয়ে গেছে। এ মত দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুৎ ছিল না, এখন বিদ্যুৎ আছে। কত বিদ্যুৎ দরকার, উৎপাদন সক্ষমতা কত বাড়ানো হবে, বিজ্ঞানভিত্তিক এই 'উন্নয়ন' দর্শন আমাদের বিদ্যুৎ খাতে অনুপস্থিত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
লোডশেডিং এর কারণ-
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি লোডশেডিং এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জাতীয় সম্পদের অপচয়। বিশেষ করে অতিমাত্রায় বিদ্যুতের অপচয় লক্ষ করা যায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে। যেখানে অযথা লাইট, ফ্যান, এসিসহ বিভিন্ন ভারি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়াও শহর - গ্রাম প্রায় সব বাসা-বাড়িতে অত্যাধিক মাত্রায় ও কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে টিভি, ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিন, হিটার, ইস্ত্রিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেগুলো বিদ্যুৎ অপচয়ের জন্য দায়ী।
এছাড়াও রান্নার কাজের জন্য অতিরিক্ত গ্যাসের ব্যবহার, কাপড় শুকানোর জন্য বৈদ্যুতিক ফ্যানের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, ম্যাচের কাঠি বাচানোর জন্য গ্যাসের চুলা জালিয়ে রাখা, বাসায় ফ্যান, লাইট চালু রেখে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকা ও বিয়ে বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা লোডশেডিং এর জন্য দায়ী।
এই দিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ তামিম বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি বিবেচনায় খরচ সাশ্রয়ের জন্য লোডশেডিংই সেরা বিকল্প। তিনি আরো বলেন- শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বহু দেশ জ্বালানি সংকটে পড়েছে। কেউ প্রস্তুত ছিল না। ইউরোপ মারাত্মক সংকটে পড়েছে। জাপান, তাইওয়ান, ভারতেও সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন - দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার কোন ঘাটতি নেই, কিন্তু উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক কাচামালের প্রাপ্যতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় দেশের গ্যাস উৎপাদনে নজর দেয়া প্রয়োজন ছিলো।
অপরদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ পেতে সরকার জামালপুরে ১শ মেগাওয়াট যে কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ ধরনের একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমরা দেশে সৌরশক্তির বড় অবদানটা বুঝতে পারবো। বিদ্যুতের ট্যারিফ বেশি হলেও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে অন্তত এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বুয়েটের অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম বলেন, সঠিকভাবে লোড ম্যানেজমেন্ট ( লোডশেডিং) গ্যাস ও বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন হারের মধ্যেও জনগণের দুর্ভোগ কমাতে পারে। দেশে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহার হয়। দেশের সকল গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবহার বন্ধেরও মাধ্যমে এর সমাধান দ্রুত সম্ভব।
অপরদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আপাতত স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে গ্যাস কেনা হচ্ছে না। এ অবস্থায় জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় সারা দেশে দিনে কয়েক ঘন্টার লোডশেডিং চলছে।
বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে আমাদের চিন্তা করার এখনই উপযুক্ত সময় । অভিযোগ বা পাল্টা অভিযোগের বিষয় নয় এটি বরং ঐক্যবদ্ধভাবে এটা সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন। তিনি বলেন, সরকার এই সমস্যার সমাধান করতে সাধ্যাতীত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বিদ্যুৎ,গ্যাস পানিসহ মৌলিক চাহিদাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের অস্থিরতার সময় বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট কমানোর গেলে এবং বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
এ দিকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এই পরিস্থিতি সাময়িক। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর কথা ভাবছেন। আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কাঁচামালের কারণে আমরা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি। যে তেল আমরা ৭০ থেকে ৭১ ডলারে কিনতাম সেটা এখন প্রায় ১৭১ ডলার হয়ে গেছে এবং মূল্য দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ জ্বালানি সাশ্রয়ে কেউ দাম বাড়াচ্ছে কেউবা ব্যবহার কমাচ্ছে । পুরো বিশ্বে এই সংকটময় সময়ের মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি করোনা পরবর্তী শিল্প উৎপাদনে বিদ্যুৎ এর চাহিদা বেড়ে যাওয়া। অর্থনীতির ভাষায় চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে আর ঘাটতি থাকলেও দাম বাড়ে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় না করলে দাম না বাড়ানোর বিকল্প থাকবে না। যদি আমরা সবাই গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়ে উঠি, তাহলে খুব দ্রুত এই পরিস্থিতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন -বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে শিডিউল অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, দোকান-পাট রাত ৮ টায় বন্ধ,তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থগিত ও সরকারি-বেসরকারি অফিসের কিছু কার্যক্রম ভার্চুয়ালি এবং সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার, অফিস টাইম কমানো, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, অফিস ভবনে বিদ্যুৎ খরচ সীমিত করার জন্য এতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রায় সারাদেশ এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। শহর, মফস্বল কিংবা অজপাড়াগাঁ সবখানেই এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সহজলভ্যতার ফলে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে, কারণে বা অকারণে বিদ্যুৎ অপচয় করে, যা আমাদের দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর।এখন সবারই উচিত বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা। আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রত্যহ অনেক বিদ্যুৎ অপচয় করে ফেলি। এর সঙ্গে দিনকে দিন বাড়তে থাকা বিভিন্ন প্রযুক্তির পণ্যের ব্যবহারতো আছেই। তাই বলে কি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন না? অবশ্যই করবেন। তবে বৈশ্বিক সংকটময় মুহূর্তে
বিদ্যুৎ ব্যবহারে অপচয় না করে বরং মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। বিদ্যুতের অপচয় কমাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক- বিদ্যুৎ অপচয় রোধে কী করণীয়-
* টিউব লাইটে ইলেকট্রিক্যাল ব্যালেষ্ট ব্যবহার না করে যদি ভালো মানের ইলেকট্রনিক্স ব্যালেষ্ট ব্যবহার করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ বিল কম আসবে অনেক।
* ফ্যানের রেগুলেটর যদি ইলেকট্রনিক্স রেগুলেটর হয় বিদ্যুৎ বিলের খরচ বেঁচে যাবে।
* দেওয়ালের বিভিন্ন পয়েন্টে অযথা চার্জার লাগিয়ে রাখলেও কিছু বিদ্যুৎ খরচ হয়। দরকার না হলে প্লাগ খুলে ও সুইচ বন্ধ করে রাখুন।
* প্রয়োজন ব্যাতীত ওভেন, ফ্যান, পিসি ইত্যাদি বন্ধ করে রাখুন।
* বিদ্যুৎ সংযোগ খারাপ বা ত্রুটিপূর্ণ হলে আপনার বিদ্যুৎ খরচ বেশি হতে পারে। খারাপ সংযোগ সারিয়ে তুলুন।
* পুরোনো লাইট বাল্ব বদলে এনার্জি সেভার বাল্ব ব্যবহার শুরু করুন। এগুলো ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে।
* ওয়াশিং মেশিন শুধু বিদ্যুৎ নয় পানিরও অপচয় করে বেশি।
* ড্রায়ারে বা ফ্যান ছেড়ে কাপড় শুকানোর বদলে বারান্দা বা ছাদে মেলে দিন।
* রেফ্রিজারেটরের কয়েল বছরে অন্তত দু’বার পরিষ্কার করিয়ে নিন। এসির ফিল্টারও পরিষ্কার রাখুন। তাহলে বিদ্যুৎ খরচ কমবে।
* পানি গরম করতে গিজার বা হিটার ব্যবহার কমিয়ে দিন।
* হেয়ার ড্রায়ারের বদলে বাতাসেই শুকিয়ে নিন চুল। এতে করে বিদ্যুতের অপচয় কমবে।
* গ্যাস সরবরাহ সচল থাকার পরও বিদ্যুৎ চালিত চুলা ব্যবহার না করা, বিদুৎ চালিত চুলা বিদ্যুৎ অপচয়ের অন্যতম কারণ।
* বাইরে বের হওয়ার সময় সব বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ করে বের হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ভুলবশত যেন কেউ রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে না পড়েন।
* ওভেন চালানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন। বিশেষ করে মাইক্রোওয়েভ। রাইস কুকার, কারি কুকার ইত্যাদি একেবারেই বাধ্য না হলে ব্যবহার করবেন না।
* নিয়ন গ্যাসীয় ডিম লাইট ও ইলেকনিং বেলাষ্ট ডিম লাইটে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। এভাবে ডিম লাইট থেকে ৫ ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়।
* বিভিন্ন উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জা কমানোর ব্যবস্থা করুন। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানেও অতিরিক্ত আলোকসজ্জা এড়িয়ে চলুন।
বর্তমানে অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অযথা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো, রাস্তার বাতি সময়মতো বন্ধ না করাসহ নানাভাবে আমরা প্রতিনিয়ত বিদ্যুতের অপচয় করছি। প্রাত্যহিক জীবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, তেল একে অপরের পরিপূরক। তাই বিদ্যুৎসহ সকল জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধ করার এখনই সময়। বিদ্যুৎসহ সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ করার উপায়গুলো -
* দিনের আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার হোক -দিনের বেলায় লাইট, ফ্যান কিংবা এসি কম ব্যবহার করে বাইরের আলো আর প্রাকৃতিক হাওয়াকে সাদরে আলিঙ্গন জানান আপন আলয়ে। ভোরবেলাতেই জেগে উঠুন রোজ। দিনের আলোয় হোক নিত্যদিনের সঙ্গী। সুস্বাস্থ্য আর সু-অভ্যাস দুটিই হবে ভোরের জাগরণে। আপনি ভরপুর হবেন প্রাণশক্তিতে, আর বেঁচে যাবে অহেতুক বিদ্যুৎ শক্তির খরচ।
* এসির ব্যবহার কমানো হোক - বাড়িতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকলেই যে সব সময় তা চালাতে হবে, তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো প্রাকৃতিক হাওয়াও উপভোগ করতে পারেন ছাদে বা বারান্দায়। বারান্দার সবুজ গাছ ঘরেও আনে শীতল পরশ।
*জ্বালানী ব্যবহারে অপচয় রোধ করি -জ্বালানী গ্যাসের প্রবাহ অবিরাম পাচ্ছেন একই টাকায় এই ভেবে দেশের সম্পদের অপচয় করা যাবে না। আমাদের মা -বোনেরা অনেকেই ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে চুলা জ্বালিয়ে রাখেন যেটা কোনভাবেই উচিৎ নয় । প্রয়োজনের অধিক জ্বালানি গ্যাস ব্যবহার না করার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ তথা জরিমানা আরোপের ব্যবস্থা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
* মোটরযানের জ্বালানি বাঁচাতেও সচেষ্ট থাকুন- আমার টাকায় আমার জ্বালানী আমি খরচ করবো এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে কারণ জ্বালানীর জন্য সরকার প্রায় ৫-১০ গুণ ভর্তুকি দেন। কম দূরত্বের জন্য মোটরসাইকেলের চেয়ে বাই সাইকেলে বা হেঁটে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। যানবাহনে বিনা প্রয়োজনে ইঞ্জিন বন্ধ রাখতে হবে।
*পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার হোক - আপনি হয়তো প্রতিনিয়ত পানি পাচ্ছেন । আবার কোথাও রাত জেগে মোটর চালিয়েও পানি পাচ্ছে না অনেকেই । সুপেয় পানির অভাব বিশ্বব্যাপী। আপনার পানির অপচয়ের কারণে হয়তো অনেক এলাকায় পানির সংকট দেখা দিবে। তাই প্রয়োজনীয় পানি ‘ব্যবহার’ করুন কিন্তু অপচয় নয়।
* কাপড় ধোয়ার যন্ত্রের সীমিত ব্যবহার হোক- কাপড় ধোয়ার যন্ত্র প্রতিদিন না চালিয়ে কাপড় জমিয়ে রেখে কয়েক দিন অন্তর চালাতে পারেন। অথবা ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারের পরিবর্তে হাতে কাপড় ধৌত করলে শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি জাতীয় সম্পদও বেঁচে যাবে।
* সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করা, পাওয়ার সেভিংস বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার।বাইরে বের হবার সময় ঘরের লাইট, ফ্যান, এসি ওয়াইফাইয়ের সুইচ অফ করবেন।
* ইজিবাইক ও অটোরিকশা বন্ধ হোক - গবেষণায় দেখা গেছে অবৈধ প্রায় ১৫ লক্ষ ইজিবাইক ও অটোরিকশায় অবৈধ চার্জেই গিলে খাচ্ছে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে - জ্বালানি সংকট হতেই পারে কিন্তু এ বিষয়ে আগে থেকেই যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে লোডশেডিং এর পরিমাণ অসহনীয় পর্যায়ে যেতো না! অনেকের ধারণা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহনে যারা প্রভাবিত করেন তারা মূলত এই ক্রাইসিসের মুখে পড়তে হয় না। লোডশেডিং যাইহোক তারা এসিতেই থাকবেন অপরদিকে সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মৌলিক চাহিদা হতে বঞ্চিত হবেন। এতে মানুষের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে, অথচ দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সুবিধা, শান্তি শৃঙ্খলা নানা সূচকে দেশর অভূতপূর্ব উন্নতি হলেও কিন্তু মৌলিক চাহিদায় প্রভাব পড়লে বাকি সব কিছু ম্লান হবে। এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে জনমানুষের ভোগান্তি রোধ করার বিকল্প নাই।
উন্নয়নশীল দেশ থেক উন্নত দেশ হওয়ার জন্য প্রত্যেক মানুষকে সততা,দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ হোক বা মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদই হোক, প্রতি ক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে আমাদের আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। বড় বড় অপচয় ও অব্যবস্থাপনা ছাড়াও আমাদের দিন যাপনে, দৈনন্দিন কাজকর্মে, চলতে-ফিরতে অসতর্কতা-অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও কর্মপরিবেশে গ্যাস, বিদুৎ, পানি, তেল ব্যবহারে ছোট ছোট অপচয় করে যাচ্ছি। দিয়াশলাইয়ের কাঠি বাঁচানো ও কাপড় শুকানোর জন্য বাসাবাড়ির গ্যাসের চুলা অকারণে জ্বালিয়ে রাখার বিষয়টি মা-বোনদের পুরনো অভ্যাস । এই অপচয়ের কারণেই হয়তো ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় এখন গ্যাস সংকট দেখা দেয়। শুধু তাই না, অপচয়ে রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায় এবং
সব ধর্মে অপচয় কে বর্জন ও মিতব্যয়িতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বলা হয়েছে- ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই '। তাই জাতির প্রতিটি কণা পরিমাণ সম্পদের যথাযথ সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য অপচয়প্রবণতা ত্যাগ করে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় মিতব্যয়ী হতে পারলে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে বলে মনে করেন দেশে বিশেষ্টজনেরা।
ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ' - ত্যাগই মানবজীবনের মহৎ আদর্শ। ত্যাগের মধ্য দিয়েই মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধিত হয়। যথার্থ মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষের পরিচয় তার ভোগ-লালসার মাধ্যমে প্রকাশ পায় না, পরের জন্য ত্যাগের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত সুখ নিহিত। মনে রাখতে হবে - সরকারের একার পক্ষে জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সম্পদ ব্যবহারে প্রত্যেকের একটুখানি সচেতনতার কারণে সাশ্রয় হওয়া বিদ্যুৎই হয়তো একজনের বড় ধরনের কোনো কাজে লাগতে পারে। অতএব, দেশের সুনাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসা এবং নিজে সচেতনতা অবলম্বনপূর্বক অপরজনকে সচেতন করার মাধ্যমে বিদুৎসহ সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় কমিয়ে দেশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করি।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
সভাপতি - সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ফাইল ছবি
জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার মতো এ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। বিগত দুই বছরে করোনার কারণে এসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান সোমবার এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি গণমধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। এর আগে রবিবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, গত দুই বছরের মতো এ বছরও জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হবে না। তিনি বলেন নতুন শিক্ষাক্রমেও এসব পরীক্ষার কথা নেই।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী বছর থেকে নতুন কারিকুলাম শুরু হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যায়ে শুরু হবে ২০২৪ সালে। ফলে আগামী বছরও পরীক্ষা নেওয়া হবে না।
গত ৩০ মে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন কারিকুলামের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় এ রূপরেখার অনুমোদন দেওয়া হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণির আগে কোনো ধরনের পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের বিধান না থাকায় চলতি বছর থেকেই এ পরীক্ষাটি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে পিইসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সূত্র: বিডি প্রতিদিন